অনলাইনে টাকা কামানোর সবচেয়ে জনপ্রিয় উপায় এখন ফ্রিল্যান্সিং৷ সহজ কথায় ‘ঘরে বসে স্মার্ট ইনকাম’৷ না অফিসে যাওয়ার ব্যস্ততা, না ৯-৫টার ক্লান্তিকর চাকরী৷ পরিবার কে অনেক সময় দেওয়া যায়, সাথে একটি কম্পিউটার ও ইন্টারনেট সংযোগের মাধ্যমে ভালো অঙ্কের অর্থ উপার্জন করা সম্ভব৷ ব্যাপারটা বেশ মজার, তাইনা?
আপনিও যদি ফ্রিল্যান্সিং কে ক্যারিয়ার হিসেবে নিতে চান আপনাকে স্বাগতম। তবে ফ্রিল্যান্সিং কে ক্যারিয়ার হিসাবে বেঁছে নিয়ে সফলতার মুখ দেখা ততটাও সহজ নয় ৷ আপনি চিন্তা করুন প্রায় ২০ বছর একাডেমিক পড়াশুনার পরে আপনি একটি মোটামুটি বেতনের চাকরি হয়ত পাবেন ৷ সেখানে ঘরে বসে উপার্জন করতে চাইলে একটুতো মেধা, শ্রম ও অধ্যবসায়ের প্রয়োজন হবেই ৷ তবে একটু নয় বরং যত বাসনা তত সাধনা ৷
ফ্রীল্যান্সিং এমন একটি পেশা যেখানে আপনি যত সামনে এগোতে চান তত দক্ষ হিসেবে নিজেকে গড়ে তুলতে হবে। প্রতিদিন নিত্যনতুন বিষয় নিয়ে জানার আগ্রহ থাকতে হবে। মনে রাখবেন, ডিজিটালাইজেশন এর এই যুগে নিজেকে ক্রমশ আপডেট করে নিতে না পারলে প্রতিযোগিতার মাঝে আপনি ছিটকে পড়বেন।
বর্তমান যুব সমাজের জন্য ‘ফ্রিল্যান্সিং’ একটি দারুণ সম্ভাবনা৷ হাত পা গুটিয়ে বেকারত্ব বরণের অভিশাপ থেকে মুক্তি পেতে কিংবা নিজে কিছু করার প্রবল ইচ্ছাই তাদের ফ্রিল্যান্সিং জগতের দিকে ঝোঁক সৃষ্টি করছে৷ তবে এই বিষদ মার্কেটপ্লেসে পা ফেলার পূর্বে জানতে হবে আসলে “ফ্রিল্যান্সিং কি?”
পড়ুনঃ ফ্রিল্যান্সিং কিভাবে শিখবো
ফ্রিল্যান্সিং কি
ফ্রিল্যান্সিং হচ্ছে ক্রিয়েটিভ ইন্ডাস্ট্রির কর্মক্ষেত্র যাকে বাংলায় বলা হয় ‘মুক্তপেশা’৷ এর সংজ্ঞা দাঁড় করালে বলা যায়, ফ্রিল্যান্সিং একটি চুক্তি ভিত্তিক পেশা যেখানে কোনো প্রতিষ্ঠানে নিয়োগের পরিবর্তে ব্যক্তি তার দক্ষতা এবং অভিজ্ঞতা ব্যবহার করে অর্থের বিনিময়ে স্বাধীনভাবে বেশ কয়েকটি ক্লায়েন্টকে সেবা প্রদান করে।
সহজ বাংলায়, আপনার কোনো একটি বিষয়ে (রাইটিং, ফটোগ্রাফি ও এডিটিং, গ্রাফিক্স ডিজাইনিং, ওয়েব ডেভেলপমেন্ট ইত্যাদি) জ্ঞান, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা থাকলে ক্লায়েন্ট আপনাকে একটি নির্দিষ্ট সময়ের চুক্তিতে কাজ প্রদান করবে৷ আপনি সেটি স্বাধীনভাবে, নিজের সুবিধামত সম্পন্ন করে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে সাবমিট করে পেমেন্ট গ্রহণ করবেন৷ ঠিক এটিই হবে ফ্রিল্যান্সিং৷ এখানে ক্লায়েন্ট আপনার কাজের বায়ার আর আপনিই আপনার বস৷
এক্ষেত্রে একসাথে একাধিক ক্লায়েন্টদের কাছ থেকে বিনা প্রতিশ্রুতিতে বিভিন্ন প্রজেক্ট বেসিসে কাজ গ্রহণ করার সুযোগ রয়েছে৷ আপনি যে পরিমাণ অ্যাসাইনমেন্ট বা কাজ নিতে চান নিতে পারবেন এবং সেই কাজ নির্ধারিত ডেডলাইনের মধ্যে ডেলিভারি করে পেমেন্ট পেয়ে যাবেন৷ ফ্রিল্যান্সিং এর সবচেয়ে চমৎকার বিষয়টি হচ্ছে এর জন্য আপনাকে সশরীরে উপস্থিত থেকে কোনো কাজ করতে হবেনা৷ এটি মূলত রিমোট জব, সেটি হতে পারে পার্ট টাইম অথবা ফুল টাইম৷
ফ্রিল্যান্সিংকে ক্যারিয়ার হিসেবে বেঁছে নেওয়া কেনো?
এই প্রশ্নের সবচেয়ে সহজ উত্তর হলো নিজের মত কাজ করার সুযোগ৷ ফ্রিল্যান্সিং এখন নতুনদেরও পছন্দের তালিকায় কারণ ফ্রিল্যান্সাররা নিজেই নিজেদের কাজ ও অবসরের সময় নির্ধারক৷ কখন কত ঘন্টা কাজ করবে এবং কখন ছুটি কাটাবে সেটি কোনো প্রতিষ্ঠান নয় বরং ব্যক্তি নিজেই নির্ধারণ করতে পারে৷
ক্যারিয়ার হিসাবে ফ্রিল্যান্সিং শুরুর আগে যা জানতে হবে?
ক্যারিয়ার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং শুরুর আগে যে দশটি বিষয় জানতে হবে?
ক্যারিয়ার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং শুরুর আগে বেসিক কিছু বিষয় জানতে হবে৷ সঠিক প্রস্তুতিই ক্যারিয়ার শুরুর ভিত৷
১. ধৈর্য্য ধারণ
স্বাভাবিকভাবেই যে কোনো কাজের শুরুটা একটু সময়সাপেক্ষ৷ তাই আপনার ক্যারিয়ার কখন প্রফেশনালি শুরু হবে তা নির্ভর করছে আপনার দক্ষতার উপর৷ আগে ফ্রিল্যান্সিং শিখুন অতপর, প্রথম কাজ পাওয়া পর্যন্ত ভেঙ্গে না পড়ে, ধৈর্য্য ধারণ করে নিজেকে দক্ষ ফ্রিল্যান্সার হিসেবে প্রস্তুত করার জন্য লেগে থাকতে হবে৷
২. মানসিক প্রস্তুতি
শুরুতেই উল্লেখ করেছি ফ্রিল্যান্সিং মূলত প্রজেক্ট বেসিসে কাজ৷ তাই সবসময় আপনার হাতে কাজ নাও থাকতে পারে৷ তাই হতাশায় না পড়ে বরং পুনরায় ক্লায়েন্ট খোঁজার দিকে ফোকাস করার মানসিক প্রস্ততি থাকতে হবে৷ মনে রাখতে হবে কোনো ক্লায়েন্টই আজীবনের জন্য নয়৷ আর অবশ্যই পুরোপুর স্কিল অর্জন না করে ফ্রিল্যান্সিং একাউন্ট তৈরি করে ফেলে রাখবেন না। ফ্রিল্যান্সিং একাউন্ট কিভাবে খুলবো এই বিষয়টি নিয়ে আমরা অন্য কোন একটা পোষ্টে নাহয় আলোচনা করবো।
৩. ফ্রিল্যান্সিং ফিল্ড ও ফিল্ড অফ ইন্টারেস্ট
ফ্রিল্যান্সিং ফিল্ডে অনেক সেক্টর রয়েছে ৷ প্রথমেই জানতে হবে আপনি কোন সেক্টরে আগ্রহী৷ নিজের পছন্দের ফিল্ড বুঝুন এবং সেটির ওপর রিসার্চ করুন৷ ফিল্ড অফ ইন্টারেস্টে এক্সপার্ট হওয়ার লক্ষ্যে ঐ ফিল্ড সম্পর্কে গভীরভাবে জানার চেষ্টা করুন৷ বহুল ফিল্ডের মধ্যে কিছু জনপ্রিয় ফিল্ডের নাম আপনাদের সুবিধার্তে উল্লেখ করছি –
- ক্রিয়েটিভ রাইটিং
- গ্রাফিক্স ডিজাইনিং
- ফটো এডিটিং
- ভিডিও এডিটিং
- মার্কেটিং
- অ্যাপ ডেভেলপার
- ওয়েব ডেভেলপার
- ডাটা এন্ট্রি
- ভার্চুয়াল অ্যাসিসটেন্ট
- এসইও
- এনিমেশন ডিজাইনার
- ব্র্যান্ডিং
- পাবলিক রিলেশন
- ইউআই/ইউএক্স ডিজাইনার
- ওয়ার্ডপ্রেস ডেভেলপার
৪. নিশ
নিশ সম্পর্কে ধারণা থাকাটা খুবই প্রয়োজনীয়৷ পছন্দের নিশ আপনার সার্ভিসকে আরো স্পেসিফিক করে৷ সহজভাবে নিশ হচ্ছে আপনার পছন্দের সেক্টরের খুবই স্পেসিফিক অংশ বা ইন্ডাস্ট্রি৷ ধরুন আপনার ফিল্ড অফ ইন্টারেস্ট হচ্ছে ক্রিয়েটিভ রাইটিং৷ আপনি সেক্ষেত্রে অনেক কিছু নিয়েই লিখতে পারেন৷ তবে আরো স্পেসিফিক বললে হতে পারে আপনার অটোমোবাইল নিশ পছন্দ কিংবা হেল্থ ও ফিটনেস ইত্যাদি৷
৫. দক্ষতা অর্জনই ক্যারিয়ারের চাবি
ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার শুরুর পূর্বের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হলো দক্ষতা অর্জন৷ নিজের পছন্দের ফিল্ডে আপনি কতটুকু দক্ষ সেটি যাচাই করুন ও নিজেকে প্রস্তুত করুন৷ নিজেকে প্রস্তুত করার জন্য বিভিন্ন আর্টিকেল, ইউটিউব ভিডিও, সোশ্যাল মিডিয়া পোস্ট, ফ্রিল্যান্সিং বই ঘাটাঘাটি করতে পারেন৷ আপনি কোনো বিষয়ে একরাতেই বিদ্যাসাগর হয়ে উঠতে পারবেন না৷ সম্পূর্ণ ফোকাস করে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি করাই পূর্ব শর্ত৷ এডভান্স হওয়ার জন্য কোনো মেন্টর এর গাইডলাইন নিতে পারেন কিংবা ইন্টার্নশীপ করতে পারেন৷
৬. পোর্টফোলিও
যে কোনো প্রজেক্ট প্রদানের পূর্বেই ক্লায়েন্ট আপনার কাজের দক্ষতার প্রমাণ দেখতে চাইবে৷ পোর্টফোলিও হলো সেটি যেটি আপনার কাজ ও কাজের দক্ষতাকে রিপ্রেজেন্ট করে৷ কোনো ক্লায়েন্ট আপনাকে কাজ দেয়ার পূর্বে আপনার কথার চেয়ে বেশি কাজ দেখে আপনার প্রতি সন্তুষ্ট হবে৷ পূর্বের কাজগুলো কিংবা কাজ শুরুর জন্য কিছু ডেমো কাজ (গিগ) ক্লায়েন্টকে দেখাতে হয় ৷ তারপর ক্লায়েন্ট বিবেচনা করে প্রজেক্ট দেবে কি দেবে না৷
৭. প্রথমেই পেইড কাজ নাও পেতে পারেন
ক্যারিয়ার শুরুর পূর্বে মানি আর্নিং বিষয়টিকেই একমাত্র বিষয়বস্তু না ভাবাই ভালো৷ আপনার পছন্দের ফিল্ডে দক্ষতা বাড়ানোর ওপর আগে ফোকাস করুন৷ সেক্ষেত্রে প্রথমে কিছু আনপেইড কাজের মাধ্যমে নিজেকে যাচাই করে নেয়া যেতে পারে৷ এতে আপনি আপনার কাজের কোয়ালিটি বুঝতে পারবেন এবং পরবর্তীতে মূল্য নির্ধারণ করতে পারবেন৷
৮. জোরালো কমিউনিকেশন স্কিল
নিজেকে ক্লায়েন্টদের সামনে তুলে ধরার জন্য তথ্যবহুল ও স্মার্টলি কথা বলতে পারা একটি অপরিহার্য বিষয়৷ ফ্রিল্যান্সার কোন বিষয়ে দক্ষ, কি সার্ভিস প্রদান করেন, কিভাবে কাজগুলো করেন সব বিষয়ে ক্লায়েন্টের সাথে গোছানো কমিউনিকেশনই ক্লায়েন্টকে কাজ দেয়ার ব্যাপারে একধাপ বেশি উৎসাহী করে তোলে৷ লেইট কমিউনিকেশন, স্লো একটিভিটির ফলে ক্লায়েন্ট ইন্টারেস্ট হারিয়ে ফেলতে পারেন৷ সেক্ষেত্রে সময়জ্ঞানও বিবেচ্য বিষয়৷ কথা বলার সময় প্রশ্নের রিলেভেন্ট উত্তর আবশ্যক৷ কমিউনিকেশনের বেলায় পেশাদার আচরণ জানা খুবই গুরুত্বপূর্ণ৷ মনে রাখতে হবে, কমিউনিটি তৈরি ও কানেকশন বৃদ্ধি জোরালো কমিউনিকেশনের মাধ্যমেই সম্ভব৷
৯. মার্কেট এনালাইসিস
অনলাইন মার্কেটে আপনার দক্ষতা কেমন সাড়া ফেলতে পারে সে বিষয়ে স্পষ্ট ধারণা থাকতে হবে৷ ক্যারিয়ার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং শুরুর আগে আপনি কোন মার্কেটপ্লেসে কাজ করতে যাচ্ছেন এবং আপনার কম্পিটিটর কারা সেসব বিষয় জেনে ফ্রিল্যান্সিং এর দুনিয়ায় প্রবেশ করুন৷
১০. সেল্ফ মার্কেটিং
আপনি কোনো বিষয়ে দক্ষ এবং সে বিষয়ে মার্কেটপ্লেসে কাজ শুরু করতে চাইলে অবশ্যই আপনাকে নিজের কাজের বিস্তৃতি মার্কেটে প্রকাশ করতে হবে৷ আপনার কাজ সম্পর্কে ক্লায়েন্ট অবগত না হলে, আপনি ফ্রিল্যান্সিং এর দুনিয়ায় এগোতে পারবেন না৷ তাই কাজের পরিসর বৃদ্ধির লক্ষ্যে এবং কানেকশন তৈরির জন্য আপনাকে জানতে হবে সেল্ফ মার্কেটিং৷ সেক্ষেত্রে বিভিন্ন ফ্রিল্যান্সিং অনলাইন প্ল্যাটফর্ম (Upwork, Fiverr, Freelancer.com, Skyword, Supersourcing, Designhill.com) সম্পর্কে জানতে হবে৷ এছাড়াও বিভিন্ন সোশ্যাল মিডিয়া নেটওয়ার্কিং (Linkedin, Facebook, Twitter) এর মাধ্যমেও কিভাবে ক্লায়েন্ট পাওয়া যায় জেনে নিতে হবে৷
ফ্রিল্যান্সিং কোনো প্যাসিভ ইনকাম সোর্স নয়৷ এটি একটি এক্টিভ আর্নিং গেটওয়ে৷ তাই যারা ক্যারিয়ার হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং শুরু করতে চাচ্ছেন তারা অবশ্যই উপরের আলোচিত বিষয়গুলো ভেবে নেবেন৷ আশাকরি আপনার ফ্রিল্যান্সিং ক্যারিয়ার অনেকটাই সহজ হবে৷