বর্তমান সময়ের সবচেয়ে জনপ্রিয় সার্চ ইঞ্জিন হলো গুগল। ইন্টারনেট ব্যবহারকারী প্রায় সবাই গুগলের সাথে পরিচিত। আমাদের জানা–অজানা যেকোনো তথ্য খুঁজে বের করার জন্য আমরা গুগলের দ্বারস্থ হয়ে থাকি। ব্যাংক, রেস্তোরা, খাবারের রেসিপি, পাহাড়–পর্বতের নাম থেকে শুরু করে আপনার প্রয়োজনীয় যা কিছুই খোজেন না কেন গুগলে পেয়ে থাকবেন। প্রচলিত একটি কথা আছে যে, যা গুগলে নেই তা পৃথিবীতে ও নেই। এই এত এত তথ্য সুসন্নিবেশিত ভাবে উপস্থাপনের জন্যই সার্চ ইঞ্জিনগুলোর মধ্যে গুগল সবার সেরা।
Global Organization of Oriented Group Language of Earth এর সংক্ষিপ্ত রূপ হচ্ছে Google যা একটি মার্কিন বহুজাতিক কোম্পানি। সুসংবদ্ধ রূপে তথ্য উপস্থাপনের উদ্দেশ্যেই গুগল প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গুগল ইন্টারনেট ভিত্তিক সার্চ ইঞ্জিন সেবা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠলেও বর্তমানে প্রায় অর্ধশত ইন্টারনেট সেবা ও পণ্য সুবিধা প্রদান করে থাকে।
গুগল ট্রান্সলেট ব্যবহার করে ইংরেজি থেকে বাংলা সহজেই অনুবাদ করার নিয়ম জানতে পড়ুনঃ
গুগল কিভাবে তৈরি হলো?
গুগল ইনকরপোরেট প্রাইভেট কোম্পানি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে ১৯৯৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর। তবে গুগলের পথচলার শুরুটা হয়েছিল ১৯৯৬ সালে ল্যারি পেইজ এবং সের্গেই ব্রিন নামে দুই বন্ধুর হাত ধরে। তারা দুজনেই তখন স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে পিএইচডি অধ্যয়নরত ছিলেন। তাঁদের রিসার্চ প্রজেক্টের অংশ হিসেবে তারা খুজে পান তখনকার সার্চ ইঞ্জিন গুলোর জটিলতা এবং সীমাবদ্ধতা। এই সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যেই তারা চিন্তাভাবনা করেন এমন একটি সার্চ ইঞ্জিন তৈরী করার যেটি একই সাথে হবে সুসজ্জিত এবং থাকবেনা কোনো জটিলতা।
আর সেই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যে তারা তৈরী করে ফেলেন ব্যাকরাব। এই সার্চ ইঞ্জিনটি তখন কোন সাইটের ব্যাকলিঙ্ক থেকে ডেটা সংগ্রহ করে ঐ সাইটের গুরুত্ব যাচাই করত। এবং পরবর্তীতে এই ব্যাকরাব সার্চ ইঞ্জিনটির নাম পরিবর্তন করে গুগল রাখা হয়। ১৯৯৭ সালের ১৫ ই সেপ্টেম্বর গুগল এর ডোমেইন নাম নির্ধারণ করা হয়। এভাবেই শুরু হতে থাকে গুগলের যাত্রা। ক্যালিফোর্নিয়ার ম্যানলো পার্কে অবস্থিত তাদের বন্ধু সুজন আচিচিকির গ্যারেজেই ১৯৯৮ সালের ৪ সেপ্টেম্বর কোম্পানি হিসেবে যাত্রা শুরু করে গুগল।
যাত্রা শুরু হওয়ার মাত্র এক মাস পর সান মাইক্রোসিস্টেম এর সহ প্রতিষ্ঠাতা মাসেএ্যান্ডি ব্যাকওলশাইম গুগলে দশ লক্ষ ইউএস ডলার বিনিয়োগ করে। এরপর ১৯৯৯ সালে বেশ কিছু বড় বড় কোম্পানি যথা SEQUOIA, ভেঞ্চার ক্যাপিটাল ফার্মস, কেলিনীনার পার্কিস্ন এতে বড় অঙ্কের টাকা বিনিয়োগ করে।১৯৯৮ সালে প্রাইভেট লিমিটেড হিসেবে প্রতিষ্টিত হওয়া কোম্পানিটি ২০০৪ সালে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানি হিসেবে তাদের পদচারণা শুরু করে। এই ২০০৪ সালেই গুগল তাদের আইপিও শেয়ার করে। এবং ল্যারি পেইজ, সের্গেই বিন এর সাথে এরিক স্কমিট ২০০৪ থেকে ২০ বছর অর্থাৎ ২০২৪ সাল পর্যন্ত একসঙ্গে কাজ করার জন্য চুক্তিবদ্ধ হন। ২০১৫ সালে গুগল ল্যারি পেজ ও সের্গেই ব্রিন এবং গুগল এর এল,সি এরই প্রতিষ্ঠিত “অ্যালফাবেট” নামক সংস্থার অন্তর্ভুক্ত হয়। তাই বর্তমানে গুগলের প্যারেন্ট কোম্পানি হল “অ্যালফাবেট“। সময়ের সাথে সাথে গুগল বৃহত্তর থেকে বৃহত্তর প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরিত হচ্ছে। এবং সেইসঙ্গে বাড়ছে গুগল এর আয়ের পরিমানও।
গুগলের আয়ের উৎস কি?
গুগলের আয়ের বেশিরভাগই আসে বিজ্ঞাপন থেকে। তবে বিজ্ঞাপন ছাড়া ও অন্যান্য উৎস যেমন, বিভিন্ন অ্যাপ, ডিভাইস, ক্লাউড সার্ভিস ইত্যাদির মাধ্যমেও গুগল আয় করে থাকে। তাহলে জেনে নেওয়া যাক, গুগল কোন কোন উৎস থেকে কিভাবে আয় করে থাকে।
গুগল অ্যাডসেন্স
যেকোনো ইউটিউব চ্যানেল কিংবা কিছু ওয়েবসাইটে গুগল নির্ধারিত বিজ্ঞাপনগুলোর মাধ্যমে ঐ ইউটিউব চ্যানেল কিংবা ওয়েবাসাইটের মালিকের যেমন আয় হয়ে থাকে, ঠিক তেমনি ওখান থেকে গুগলেরও আয় হয়ে থাকে। এই পদ্ধতিটি গুগল অ্যাডসেন্স এর মাধ্যমে হয়ে থাকে। গুগল অ্যাডসেন্সের মাধ্যমে তৃতীয় পক্ষের কোনো একটি বিজ্ঞাপন নির্দিষ্ট শর্তসাপেক্ষে বিভিন্ন ইউটিউব চ্যানেল কিংবা ওয়েবসাইটে দেখানো হয়। এই গুগল অ্যাডসেন্সের মাধ্যমে দেখানো বিজ্ঞাপনগুলোর বিজ্ঞাপনদাতাদের নিকট থেকে প্রাপ্ত অর্থের ৩২ থেকে ৪৯ শতাংশ অর্থ গুগল নিয়ে থাকে। এবং বাকি অংশ ঐ ওয়েবসাইট টি যাদের মালিকানাধীন তাদের দিয়ে থাকে। তাই গুগল অ্যাডসেন্স গুগল এর আয়ের অন্যতম বড় একটি মাধ্যম।
গুগল অ্যাডওয়ার্ডস
গুগল অ্যাডওয়ার্ডস ও গুগলের বিজ্ঞাপনের মাধ্যম। এখানে বিজ্ঞাপনদাতারা বিভিন্ন কি–ওয়ার্ড এর জন্য বিডিং ও করে থাকে। যখন আমরা কোনো একটি কি–ওয়ার্ড লিখে গুগলে সার্চ করি তখন আমাদের ঐ কাঙ্ক্ষিত বিষয়টিকে সার্চ ইঞ্জিনের প্রথম পৃষ্ঠায় দশটি ওয়েবসাইটের মধ্যে না পেলে দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় আর যাই নাহ। পরবর্তীতে অন্য কি–ওয়ার্ড ব্যবহার করে সার্চ করে থাকি। আর এক্ষেত্রে যেকোনো ওয়েবাসাইটের মালিকের লক্ষ্য থাকে যেন কোনো একটি নির্দিষ্ট কি–ওয়ার্ড এ যে কেউ কোনো কিছু সার্চ করলে যাতে সবার আগে তার ওয়েবসাইটটি আসে। আর এজন্যই কোনো একটি নির্দিষ্ট কি–ওয়ার্ডে সার্চ করলে নিজেদের ওয়েবসাইটটিকে আগে র্যাংকিং করার জন্য বিভিন্ন ওয়েবসাইটের মালিক গুগলে তাঁদের বিজ্ঞাপন দিয়ে থাকে। আর এই বিজ্ঞাপনগুলো দেওয়ার জন্য গুগল Cost Per Click অর্থাৎ CPC নির্ধারণ করে থাকে। যখন কেউ ওই বিজ্ঞাপনে ক্লিক করে তখন তা থেকে গুগল আয় করে থাকে।
গুগল অ্যাডমোব
মূলত গুগল অ্যাডসেন্সের মোবাইল ভার্সন হচ্ছে গুগল অ্যাডমোব। মোবাইল অ্যাপসে বিভিন্ন বিজ্ঞাপন মূলত গুগল অ্যাডমোব এর মাধ্যমে দেওয়া হয়। বিভিন্ন কোম্পানি তাঁদের বিজ্ঞাপন অ্যাডমোব এর মাধ্যমে মোবাইল অ্যাপস গুলোতে প্রচার করে থাকে। বিভিন্ন সময় গুগল প্লে স্টোর থেকে আমাদের প্রয়োজনীয় অ্যাপস মোবাইলে ইনস্টল করি। ঐ অ্যাপস গুলো ইনস্টলের পর চালানোর সময় যদি আমাদের ইন্টারনেট সংযোগ চালু থাকে তবে আমরা বিভিন্ন অ্যাড দেখতে পাই। মূলত এই অ্যাডগুলোই গুগল অ্যাডমোব এর মাধ্যমে দেওয়া হয়। আমরা যখন এই অ্যাড গুলো দেখে থাকি তখন এর থেকে অর্জিত অর্থের কিছু অংশ গুগল পেয়ে থাকে। তাই গুগল অ্যাডমোবের মাধ্যমে ও প্রচুর আয় করে থাকে।
গুগল প্লে স্টোর
আমাদের অ্যান্ড্রয়েড ফোনগুলোতে যখনই কোনো একটি অ্যাপসের প্রয়োজন পড়ে তখনই আমাদের দ্বারস্থ হতে হয় গুগল প্লে স্টোর এর। এই গুগল প্লে স্টোরে আমরা ফটো এডিটিং থেকে শুরু করে বই, মিউজিক, গেম সবধরনের অ্যাপ পেয়ে থাকি। এই গুগল প্লে স্টোরে প্রাপ্ত হরেক রকমের এই অ্যাপগুলো মূলত বিভিন্ন অ্যাপ ডেভেলপার, সফটওয়্যার কোম্পানির। কিন্তু যখন কোনো একজব অ্যাপ ডেভেলপার কিংবা সফটওয়্যার কোম্পানি তাদের অ্যাপ গুলো গুগল প্লে স্টোরে ছাড়ে তখন তাদের এর জন্য নির্ধারিত কিছু অর্থ গুগলকে দিতে হয়। তাই প্রতিনিয়ত গুগল প্লে স্টোরে নতুন নতুন অ্যাপ জমা হওয়ার সাথে সাথে বাড়ছে গুগলের আয়।
গুগল ম্যাপ
সাধারণত আমরা যখন গুগল ম্যাপ ব্যবহার করে থাকি গুগল আমাদের থেকে কোনো ফি বা অর্থ চার্জ করে না। কিন্তু বর্তমানে বিভিন্ন ট্রান্সপোর্ট প্রতিষ্ঠান গুলো গুগল ম্যাপের API ব্যবহার করে থাকে। এক্ষেত্রে গুগল অর্থ উপার্জন করে থাকে। AirBnb, Uber, Trivago ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানগুলো গুগল ম্যাপের API ব্যবহার করে থাকে। যেমন, এসব রাইড শেয়ারিং কোম্পানিগুলো তাদের অ্যাপের সাথে গুগল ম্যাপ এর সংযোগ করে থাকে। এসব প্রতিষ্ঠানের কাস্টমাররা যখন এর সেবা নিয়ে থাকে তখন ড্রাইভার এবং কাস্টমার একে অপরের মুভমেন্ট ট্র্যাক করতে পারে অ্যাপ গুলোর গুগল ম্যাপের API ব্যবহারের ফলে। আর এই জন্য গুগলকে এই ধরনের প্রতিষ্ঠানরা নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করে থাকে।
গুগল ট্রান্সলেট
গুগল ট্রান্সলেট এর মাধ্যমে আমরা বিভিন্ন ভাষার পরিবর্তন করে থাকি। মূলত গুগলের এই সেবাটি আমরা যদি কেউ ব্যক্তিগতভাবে গ্রহণ করি তবে কোনো অর্থ প্রদান ব্যতীতই করতে পারি। কিন্তু যখন কোনো প্রতিষ্ঠান ব্যবসায়িক সুবিধার্থে গুগল ট্রান্সলেটের API ব্যবহার করে থাকে তখন গুগলকে ঐ প্রতিষ্ঠানটি নির্ধারিত অর্থ পরিশোধ করে থাকে। যেমন বিভিন্ন ধরনের ট্রান্সলেশন নির্ভর অ্যাপ বা কোম্পানিগুলোর কাছে গুগল ট্রান্সলেট API সেল করে থাকে। বিনিময়ে গুগল প্রচুর পরিমাণ অর্থ উপার্জন করে।
গুগল অ্যাপ
লক্ষ্য করে দেখবেন আপনার হাতের অ্যান্ড্রয়েড ফোনটিতে গুগলের অ্যাপগুলো যেমন, জিমেইল, গুগল ম্যাপস, গুগল ড্রাইভ ইত্যাদি ডিফল্টভাবে দেওয়া আছে। আর গুগল এসব অ্যাপে বিজ্ঞাপনের মাধ্যমে অর্থ উপার্জন করে থাকে। এইসব অ্যাপ আমরা সচরাচর ফ্রিতে ব্যবহার করে থাকলেও যখন এগুলো আপগ্রেড ফিচার গুলো ব্যবহার করতে হয় তখন এসবের জন্য অর্থ প্রদান করতে হয়। এছাড়াও বিভিন্ন সময় আমাদের বিভিন্ন প্রয়োজনে গুগলের বিভিন্ন ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করতে হয়। আর এক্ষেত্রে কিছু নির্দিষ্ট সময় ঐ প্ল্যাটফর্মটি ব্যবহারের জন্য টাকার বিনিময়ে সাবস্ক্রিপশন কিনে নিতে হয়।
গুগল ক্লাউড সার্ভিস
ডেটা স্টোরেজ, ডেটা অ্যানালিটিক্স, নেটওয়ার্কিং, মেশিং লার্নিং সহ বিভিন্ন সেবা গুগল ক্লাউড সার্ভিস এর মাধ্যমে পাওয়া যায়। এই গুগল ক্লাউড সার্ভিস ব্যবহার করতে হলে টাকা পরিশোধ করতে হয়। আর অন্যান্য ওয়েব ক্লাউড সার্ভিস ব্যবহার জটিলতার কারণে গুগল ক্লাউড সার্ভিস অনেক বেশি জনপ্রিয়। জনপ্রিয়তার সাথে ব্যবহারকারীর সংখ্যা যেমন অপ্রতুল ঠিক তেমনি গুগলের আয়ও অনেক বেশি হচ্ছে গুগল ক্লাউড সার্ভিসের দ্বারা।
এছাড়াও গুগল তাদের বিভিন্নসময় তৈরীকৃত বিভিন্ন ডিভাইস যেমন, পিক্সেল, ওয়ান প্লাস, ক্রোমবুক ইত্যাদি থেকেও প্রচুর পরিমাণ অর্থ আয় করে থাকে।
পরিশেষে বর্ণিত বিষয়গুলোর মাধ্যমে আমরা জানতে পারলাম যে সচরাচর আমরা কোনো অর্থের বিনিময় ছাড়া গুগল ব্যবহার করে থাকলেও গুগলের আয়ের পরিমাণ এবং আয়ের উৎস ও কিন্তু কম বিস্তর নয়। তবে বিভিন্ন উৎস থেকে গুগল আয় করে থাকলে ও বিজ্ঞাপনই কিন্তু গুগলের আয়ের সিংহভাগ যোগান দিয়ে থাকে। এবং আয়ের পরিধি বাড়ার সাথে সময়ের পরিক্রমায় আমাদের দৈনন্দিন ব্যবহ্রত এই গুগল বৃহত্তর পরিসর ধারণ করছে।